মোঃ মাহ্ফুজুর রহমান, রাজবাড়ী টুডে ডট কম:
নিপুণ শিল্পকর্মে গড়ে তোলা কুঁড়ে ঘর সদৃশ্য দৃষ্টি নন্দন ঝুলন্ত বাসা তৈরির জন্য বাবুই পাখি বিখ্যাত। চিরচেনা বাবুই পাখির স্বাধীনতা আর সুখ দুই-ই আজ হুমকির মুখে। বসবাস উপযোগী পরিবেশ বিঘ্নিত হওয়ায় হারিয়ে যেতে বসেছে শৈল্পিক বাসার কারিগর বাবুই ।
মাত্র এক যুগ আগেও বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বত্র চোখে পড়তো বাবুই পাখি। গ্রাম বাংলার মাঠের ধারে, পুকুর কিংবা মাঠের পাড়ে প্রহরীর মতো দাঁড়িয়ে থাকা তালগাছ হারিয়ে গেছে ইটভাটার আগ্রাসনে। তেমনি হারাতে বসেছে প্রকৃতির শিল্পী পাখির ভোরবেলার কিচিরমিচির সুমধুর ডাকাডাকি আর উড়াউড়ি।
এখন আর সারিবদ্ধ প্রহরী তালগাছের পাতায় ঝুলতে দেখা যায় না তাদের শৈল্পিক বাসা। কিচির মিচির শব্দে মুখর হয় না গ্রামবাংলার জনপদ। নির্বিচারে বৃক্ষ নিধন, কীটনাশকের ব্যবহার, শিকারিদের নানা কৌশলের পাখি শিকার, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে এ পাখি বিলুপ্ত হতে বসেছে। তাছাড়া সেই তালগাছের সারিও আজ খুব একটা চোখে পড়ে না।
বাবুই পাখিকে অনেকে কারিগরি পাখিও বলে থাকে । নলখাগড়া ও হোগলাপাতা দিয়ে বাবুই বাসা বোনে। সে বাসা যেমন আকর্ষণীয়, তেমনি মজবুত। শক্ত বুননের বাসা সহজে ছেঁড়া যায় না। প্রচন্ড ঝড়ে ছিঁড়ে পড়ে না এই শিল্পি পাখির বাসাটা। তালগাছের সঙ্গে যথার্থ সহবাস।
কঠোর শ্রম সাধনায় বাবুই পাখিদের বাসা যেমন দৃষ্টিনন্দন, তেমনি টেকসই। যে খড় কুটোর বাসা প্রবল ঝড়েও টিকে থাকতো। এ পাখির বাসা মানুষের মানবিক ও সৌন্দর্য বোধকে জাগ্রত করার পাশাপাশি দেয় স্বাবলম্বী হওয়ার অনুপ্রেরণা।
বাসা বানোনোর জন্য বাবুই খুব পরিশ্রম করে। ঠোঁট দিয়ে ঘাসের আস্তরণ ছড়ায়। পেট দিয়ে ঘষে গোল অবয়ব মৃসণ করে। শুরুতে দুটি নিম্নমুখী গর্ত থাকে। পরে একদিকে বন্ধ করে ডিম রাখার জায়গা হয়। অন্যদিকে লম্বা কওে প্রবেশ ও প্রশস্ত পথ তৈরি করে।
কথিত আছে নাগরিক সুবিধা পেতে রাতে বাসায় আলো জ্বালার জন্য বাবুই জোনাকি ধরে এনে গোঁজে। বাবুই সাধারণত গ্রামের নারকেল, খেজুর, রেইনট্রি ও আখ ক্ষেতে এবং বিশেষ করে তাল গাছে দল বেঁধে বাসা বোনে। এদেশে রয়েছে দেশি, দাগি ও বাংলা এ তিন প্রজাতির বাবুই পাখি । এদের মধ্যে দাগি বাবুই ও বাংলা বাবুইর প্রজাতি বিলুপ্তির পথে।
তবে দেশি বাবুই গ্রাম-গঞ্জে এখনও কিছু দেখা যায়। এরা সাধারণত বিভিন্ন ফসলের বীজ, ধান, পোকা, ঘাস, ছোট উদ্ভিদের পাতা, ফুলের মধু ও রেণু প্রভৃতি খেয়ে জীবনধারণ করে। কখনো-সখনো নিরুপায় হয়ে গ্রামের কুঁড়ে ঘরের কোনটিতে বাসা বাঁধলেও মূলতঃ তালগাছে বাসা বাঁধতেই বেশী সাচ্ছন্দ বোধ করে বাবুই পাখি। কিচিরমিচির শব্দে মাঠে প্রান্তরে উড়ে উড়ে খড়কুটো সংগ্রহ করে তালগাছে বাসা বাঁধে তারা।
বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে জানা গেছে, গ্রামে গ্রামে অনেক তালগাছ ছিলো। দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। আশপাশে ইটভাটা হয়েছে। মানুষ গাছ কাটে ভাটায় বিক্রি করছে। গ্রাম বাংলায় এখনো কিছুকিছু বাবুই পাখির উড়াউড়ি চোখে পড়লেও তালগাছে বাবুই পাখির বাসা চোখে মেলা কঠিন।
পরিবেশ বিপর্যয়ের ধাক্কায় জীববৈচিত্রে এ পরিবর্তন। যদি বাসা ও খাদ্য ব্যবস্থা না থাকে তাহলে ওরা তো হারিয়ে যাবেই। দেশের সর্বত্রই একসময় বাবুই পাখি ও তার দৃষ্টিনন্দন ঝুলন্ত বাসা দেখা যেত।
তাল জাতীয় গাছে এ পাখি বাস করতো। গাছ কমে যওয়ায় বাবুই পাখির আবাসস্থল নষ্ট হয়ে যাওয়াই বাবুই পাখি কমে যাওয়ার প্রধান কারণ। বাবুই পাখি ও তার বাসা টিকিয়ে রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা প্রয়োজন।