মোঃ মাহ্ফুজুর রহমান, রাজবাড়ী টুডে ডট কম:
কাশফুল শোভন শুভ্র ফুল। প্রকৃতিতে কাশফুলের আনাগোনা দেখলেই প্রাণবন্ত ঋতু শরৎকালের রবি উদয় ঘটে প্রাণে। শরৎ ও কাশফুল যেন একই সুতার মালা। শরতের শ্রেত কাশফুলের সাথে সাদা মেঘের মিতালি দেখা যায় পুরো শরৎকাল জুড়েই। বিস্তীর্ণ নীল আকাশে শ্রেত মেঘের ভেলা আর কাশফুলের সমারোহ শরৎ প্রকৃতির এক নান্দনিক রূপ।
গ্রাম বাংলার প্রকৃতির অপরুপ শোভা ও সৌন্দর্য্যরে অধিকারী কাশবন এখন আর চোখে পড়ে না। কালের বিবর্তনে বিলুপ্তির পথে কাশফুল। যুগ যুগ পেড়িয়ে গেলেও গ্রাম বাংলার নদ-নদীর ধার, ঝোপ-ঝাড়, জঙ্গল, পুকুর, খাল-বিল, ঈদ গাঁহ মাঠ ও ফাঁকা জায়গায় পথচারীদের দৃষ্টি কাড়তে কাশফুলের হালকা বাতাস যেন দোলা দেয় সবার হৃদয়কে। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যেত কাশফুলের সৌন্দর্য্যে। ধবল কাশফুল শোভন সুন্দর বলে সবুজ প্রাণ আর মেঘের আকাশ মিলে মূর্ত প্রকৃতি নয়নাভিরাম হয়ে ওঠে।
কাশফুল আবহমান বাংলার চিরচেনা শরতের সুন্দর স্নিগ্ধ ফুল। বহুযুগ থেকে রাজবাড়ী সদর উপজেলার গোদার বাজার চরাঞ্চল, গোয়ালন্দ উপজেলাধীন দৌলতদিয়া ইউনিয়ন, উজানচর ইউনিয়ন পদ্মা নদী তীরবর্তি এলাকা সহ বিভিন্ন এলাকায় অহরহ কাশফুল ফুটলেও এখন আর চোখে পড়ে না চিরচেনা কাশফুলের এমন দৃশ্যে। ফলে অনেকে কাশফুলকে ভুলতে বসেছে। তবে এবার সদর উপজেলার ঢাকা- খুলনা মহাসড়কের পাশ্ববর্তি খানখানাপুর বড় ব্রীজ এলাকায় কাশফুলের দৃশ্যে নয়ন জুড়িয়ে আসে।
পরিচয়: সাদা লোমের মতো শুভ্রতা নিয়ে ফোটে কাশফুল। গুচ্ছমূল জাতের উদ্ভিদ ঘাস কাশফুল। এর মঞ্জুরি ১৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার লম্বা হয়। এর পাতা কিছুটা রুক্ষতায় সরু সোজা রেখার মতো। উচ্চতা তিন থেকে সাড়ে তিন মিটার পর্যন্ত হয়। কাশফুলের পাতাগুলো খসখসে, ধারালো হলেও কাশফুলগুলো খুবই নরম এবং কোমল। সাদা তুলার মতোই তুলতুলে এই ফুল।
জন্ম স্থান: নদীর ধার, চরাঞ্চল, জলাভূমি, পাহাড় কিংবা গ্রামের কোনো উঁচু জায়গায় কাশের ঝাড় বেড়ে ওঠে। তবে নদীর তীরেই এদের বেশি জন্মাতে দেখা যায়। এর কারণ হল নদীর তীরে পলিমাটির আস্তর থাকে এবং এই মাটিতে কাশের মূল সহজে সম্প্রসারিত হতে পারে। শরৎ ঋতুতে কাশফুল ফোঁটে। বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই কাশফুল দেখতে পাওয়া যায়।
বংশ বিস্তার: গ্রামের বাড়ী বা পুকুর পাড়ে ইচ্ছা করলে কাশফুল লাগানো যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে কিছুটা ঠান্ডা ও বালু মিশ্রিত স্থান বেছে নিতে হবে। কাশফুল বীজে সূক্ষ্ম সাদা রোম থাকে। এই রোমের কারণেই অক্টোবর-নভেম্বরে বীজগুলো উড়ে বেড়ায় এবং কাশফুলের বংশ বিস্তার হয়।
কাশফুলের ব্যবহার : কাশফুল কেবল প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে না। কাশ খড় গরু-মহিষেরও প্রিয় খাদ্যও। কাশ ঘাস শুকিয়ে গ্রাম দেশে মাদুর, ঘরের বেড়া ও ঘরের চালার ছাউনি, খড় ও ঝাটি পান-বরজের ছাউনি দেওয়া হয়। এছাড়া পান-লতাকে উপরে উঠতে শলার (কঞ্চি) সাথে বেঁধে রাখতে খুব দরকারি শুকনো কাশ খড়। শুকনা কাশ গ্রামের মানুষ জ্বালানি হিসাবে ব্যবহার করে। ফলে কাশবন যেমন শরৎকালে প্রকৃতির শোভা বর্ধন করে, তেমনি এ উদ্ভিদের একটি বাণিজ্যিক গুরুত্ব রয়েছে। এছাড়া অল্প সংখ্যক কাশফুল চোখে পড়লেও চাহিদা রয়েছে কয়েকগুন। উদ্ভিদটির এতগুন থাকার পরেও গাছ বা বাগান করা সহ সংরক্ষণ ও রক্ষায় কোন উদ্যোগ নেই।
বাণিজ্যিক আবাদ: কাশবন উপকূলের নদ ও নদীর তীরে প্রকৃতিগত ভাবে জন্মালেও দেশের কোথাও কোথাও এর বাণিজ্যিক আবাদ রয়েছে। সাধারণত গজিয়ে ওঠা কাশবনের আগাছা পরিষ্কার করে কিছুটা সার দিলে এর আবাদ সম্প্রসারণে অধিক সুবিধা মেলে। প্রতি বছর শীত মৌসুমে কাশবন কেটে তা শুকিয়ে প্রক্রিয়াজাত করা হয়।
কাশফুলের গাছগুলো মানুষের জন্য খুব উপকারী। ব্যক্তি পর্যায়ে কাশবন বা কাশফুলের গাছ সংরক্ষণে কৃষকদের মাঝে গনসচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। এমনকি কাশফুল বা বাগান ব্যক্তি, সংগঠন, সরকারী দপ্তরের বন বিভাগ ও বেসরকারী পর্যায়ে সংরক্ষণ করতে জোরদাবী জানিয়েছেন সচেতন মহল।
যদিও পরিবর্তিত জলবায়ুর কারণে শরতের অপরূপ সেই রূপ-মাধুর্য এখন আর আগের মতো নেই। তবুও ঋতুচক্রে শরৎ আসে। আর এই ঋতুচক্রের বর্ণিল দোলায় উদ্ভাসিত হোক স্নিগ্ধ শরতের শুভ্র কাশফুল।
দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি, নদ-নদী ভরাট, পতিত স্থান ও উচু জমি হ্রাস পাওয়ায় কাশফুল কমে যাচ্ছে। ফলে প্রকৃতির অপরুপ শোভা দানকারী ও সৌন্দর্য্যরে প্রতীক কাশবন (ফুল) এখন বিলুপ্তির পথে।